আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ
ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ শুরু হওয়ার পরপরই রাশিয়ার কর্মকর্তারা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির এ পদক্ষেপকে ‘উদ্বেগজনক’ ও ‘বিপজ্জনক’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
রুশ গণমাধ্যমগুলোকে সেসময় অতটা উদ্বিগ্ন মনে হয়নি। কেউ কেউ তেহরান-তেল আবিব সংঘাতে মস্কোর কী কী লাভ, সেটাও জানাতে শুরু করেছিল, বলছে বিবিসি।
সেসময় রুশ সংবাদমাধ্যমগুলোর দৃষ্টিতে যা যা ইতিবাচক মনে হয়েছিল, তার মধ্যে আছে- তেলের দাম বেড়ে যাওয়া, যা রাশিয়ার কোষাগার স্ফীত করবে।
মধ্যপ্রাচ্য উত্তপ্ত হওয়ায় বিশ্বের মনোযোগ ইউক্রেইনে রাশিয়ার অভিযান থেকে সরে যাবে বলেও তারা ‘নিশ্চিত’ ছিল। মস্কোভস্কি কোমসোমোলেটসের এক শিরোনামে লেখা ছিল ‘কিইভ বিস্মৃত’।
এদিকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে মধ্যস্থতারও প্রস্তাব দিয়েছেন। সেই প্রস্তাব গৃহীত হলে রাশিয়া নিজেকে মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী’ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবে।
রুশ গণমাধ্যমগুলোতে এখন সেসব আশাবাদের জায়গায় উদ্বেগ ফিরে এসেছে। তারা বুঝতে পারছে, ইরানে ইসরায়েলের অভিযান এবং সেই সূত্রে পাল্টাপাল্টি হামলা যত দীর্ঘায়িত হবে, ততই মস্কোর লাভের চেয়ে হারানোর পরিমাণ বেশি হতে পারে।
“সংঘাত বাড়লে মস্কো গুরুতর ঝুঁকি ও সম্ভাব্য ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। যেটা সত্য সেটা হচ্ছে- রাশিয়া এমন একটি দেশে ইসরায়েলের বড়সড় হামলা ঠেকাতে পারল না, যে দেশের সঙ্গে মাত্র ৫ মাস আগেই মস্কো বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল।
“স্পষ্টতই মস্কো এখন ইসরায়েলের নিন্দা জানিয়ে রাজনৈতিক বিবৃতি দেওয়ার বাইরে কিছু করার মতো অবস্থায় নেই। তারা ইরানকে সামরিক সহায়তা দিতেও প্রস্তুত নয়,” সোমবার ব্যবসা-বাণিজ্যবিষয়ক দৈনিক কমারসান্তে এমনটাই লিখেছেন রুশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আন্দ্রেই কোর্তুনভ।
চলতি বছরের শুরুর দিকে রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে ওই কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি হয়েছিল। দুই দেশের দুই প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মাসুদ পেজেশকিয়ান এতে স্বাক্ষর করেছিলেন।
এতে অবশ্য তেহরানের প্রতিরক্ষায় মস্কোর ছুটে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই।চুক্তিটি হওয়ার পর মস্কো অবশ্য এ নিয়ে ব্যাপক উৎফুল্লও ছিল।
বার্তা সংস্থা রিয়া নভোস্তিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ চুক্তির ব্যাপারে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, “চুক্তিতে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্তরে শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে দুই দেশের মধ্যে সমন্বয় জোরদারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ, এবং মস্কো-তেহরানের মধ্যে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার আকাঙ্ক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।”
মাত্র ছয় মাস আগেই রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে তার অন্যতম মিত্রকে হারিয়েছে, সিরিয়ার বাশার-আল-আসাদ।
ডিসেম্বরে ক্ষমতাচ্যুত বাশার পরে রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। এখন যদি ইসরায়েলের চাহিদা মতো ইরানেও শাসকগোষ্ঠীর পতন হয়, তাহলে মস্কো এই অঞ্চলে আরেক কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারকে হারাবে, যা তাদের জন্য বেশ বড় ধাক্কা হয়ে আসতে পারে।
ইরানকে সহায়তা করার নৈতিক দায়ও আছে রাশিয়ার। কিছুকাল আগেও তারা ইউক্রেইনে অভিযানে ইরানের শাহেদ ড্রোনের ওপর বেশ নির্ভরশীল ছিল। যদিও এখন তারা স্থানীয়ভাবেই এ ধরনের ড্রোন বানাচ্ছে বলে জানা গেছে।
মঙ্গলবার মস্কোভস্কি কোমসোমোলেটস মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে যে মন্তব্য করেছে, সেখানে ইরান ঘিরে তাদের উদ্বেগ ফুটেও উঠেছে।
“দুনিয়ার রাজনীতিতে এখন যে ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে, তা আমাদের দেশের জনজীবনেও ব্যাপক প্রভাব ফেলবে,” বলেছে তারা।
ভ্লাদিমির পুতিনকে আগামী কয়েকদিন কাটাতে হবে বার্ষিক সেইন্ট পিটার্সবার্গ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ফোরামে। এই আয়োজনকে একসময় ‘রাশিয়ার দাভোস’ বলা হলেও ইউক্রেইনের মস্কোর সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক কোম্পানি এখন এই অনুষ্ঠানে থাকে না।
তা সত্ত্বেও এবারও ১৪০টির বেশি দেশের প্রতিনিধিরা এই আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে থাকবেন বলে আয়োজকরা বলছেন।
হতে পারে এটি অর্থনৈতিক ফোরাম, কিন্তু ভূ-রাজনীতি থেকে খুব একটা দূরেও নয়। সেখানে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে পুতিন কিছু বলেন কি না, বললে কি বলেন, তার ওপর বিশ্বের অনেকেরই চোখ থাকবে।
Leave a Reply