অভিভাবক ও আত্মীস্বজনরা ছুটছিলেন। ছুটতে ছুটতে খোঁজ না পেয়ে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায় নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিলেন। খোঁজাখুঁজি করে ‘খোঁজ’ না পেয়ে কাঁদছিলেন অঝোরে। কিন্তু শুধু কান্না করলেই কি হবে? কান্নার জল মুছতে মুছতেও ছুটছিলেন। বিধ্বস্ত বিমান থেকে আগুনের ধোঁয়া উড়ছিল, বহু ছেলেমেয়েকে উদ্ধার করা হচ্ছিল, ভিড়ের মধ্যে মা-বাবা ও স্বজনদের চোখ শুধুই খুঁজছিল। তাঁদের জোড়া জোড়া চোখ খুঁজছিল সন্তানদের।
কেউ দুই সন্তানের একজনের খোঁজ পেয়েছিলেন তো আরেকজনের কোনো খোঁজ পাচ্ছিলেন না। তাই এক হাতে এক ছেলেকে নিয়ে অন্য সন্তানের জন্য ছুটছিলেন।
ছুটছিলেন তাঁরা স্কুল থেকে হাসপাতালে। কিন্তু কোথাও সন্তানকে না পেয়ে আরো ব্যাকুল হয়ে ওঠেন তাঁরা। গতকাল সোমবার দুপুরে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই অভিভাবকদের এই ছোটাছুটি শুরু হয়।
তাঁরা প্রথমে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে ভিড় করতে থাকেন।
দুপুর ১টার পর স্কুলের দোতলা ভবনে ঢোকার মুখে বিমানটি বিধ্বস্ত হলে আগুন ধরে যায়। দুর্ঘটনাস্থল থেকে একের পর এক অগ্নিদগ্ধদের নেওয়া হয় জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ও বিভিন্ন হাসপাতালে। বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয় ২৮ জনকে। কয়েকজনকে নেওয়া হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালেও (সিএমএইচ)। ঘটনাস্থলে উদ্ধার তত্পরতা চালাচ্ছিলেন সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।
ঘটনাস্থলে মোতায়েন করা হয় বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) সদস্যদের। পুলিশও ছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যস্ত।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে তখন ভিড় অভিভাবকদের। বিকেল ৩টায় ঘটনাস্থলে অভিভাবক লাকি আক্তার জানান, তাঁর দুই সন্তান মাইলস্টোন স্কুলে পড়ে। বড় সন্তানকে বের করে এনেছেন। কিন্তু তখন ছোট ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ফেরদৌসী বেগমের মেয়ে বিধ্বস্ত ভবনের কাছে ভেতরে আটকা পড়েছিল। মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না বলে অস্থির হয়ে ওঠেন ফেরদৌসী।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সবুজ মিয়া গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, দোতলা ভবনটিতে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয়। ক্লাস শেষ হয়েছিল দুপুর ১টায়। কিছু শিক্ষার্থী বেরও হয়েছিল। অনেকে অভিভাবকদের জন্য অপেক্ষায় বসে ছিল। আর তখনই বিমান বিধ্বস্ত হয়ে আগুন ধরে যায়। দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল ঘিরে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয়।
একাধিক শিক্ষার্থী জানায়, প্রজেক্ট-২ ভবনের সামনে বিমানটি পড়েছিল। ভবনে দুটি তলা মিলিয়ে মোট ১৬টি শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষকদের কক্ষ চারটি। প্রাথমিকের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস হতো এ ভবনে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শ্রেণিকক্ষের সামনে বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। বিমান পতিত হওয়ার সময় ক্লাস চলছিল। কিছুক্ষণ পর ক্লাস শেষ হওয়ার কথা। ওই সময় কলেজের প্রজেক্ট-৭ নম্বর ভবনে বিমানটির ধাক্কা লাগে। পরে প্রজেক্ট-২ ভবনের সামনে পতিত হয়।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী কাব্য জানায়, দুপুর ১টায় তার ক্লাস শেষ হয়ে যায়। ক্লাস থেকে তখন সে বের হচ্ছিল। তখন শুনতে পায় বিকট শব্দের বিস্ফোরণ। সে দেখতে পায়, বিস্ফোরণের পর দোতলা ভবনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে, সেখানে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস হতো। দুপুর ১টার দিকে তাদের ছুটি হয়ে যায়। তবে তখনো কিছু শিক্ষার্থী সেখানে অবস্থান করছিল।
দুর্ঘটনার পর জাতীয় বার্ন ও প্লস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন স্থানে সন্তানের খোঁজে, কেউ পুড়ে যাওয়া সন্তানকে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। সেখানে ৫২০ নম্বর কক্ষের মেঝেতে মেয়েকে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন ইয়াসমিন আক্তার। কাছে গিয়ে জানা গেল, তাঁর ১১ বছরের মেয়ে নুরে জান্নাত ইউশার শরীর পুড়ে গেছে। ইউশা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। ইউশার কপাল পুড়ে গেছে, ঝলসে গেছে মুখমণ্ডল, মাথাও ফেটেছে, পুড়ে গেছে পিঠও। মেয়ে ইউশা তখন বলছিল, ‘মা, আমার শরীর জ্বলছে।’ মেয়ের শরীরের এই জ্বালায় মা-ও যেন জ্বলছিলেন। কিন্তু তাঁর এই জ্বালার কথা কাউকে বলতে পারছিলেন না। চোখ বেয়ে ঝরছিল জল। এই দৃশ্য অন্য আরো অনেককে ব্যথাতুর করে তোলে। ৫২০ নম্বর কক্ষের সামনে নাসিমা বেগম অস্থির হয়ে বিলাপ করছিলেন। অন্যদের প্রবোধের ভাষা তিনি বুঝতে পারছিলেন না, শুনতে পারছিলেন না। তাঁর ছেলে রবিউল হাসান রোহানের শরীর পুড়ে গেছে। সে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। নাসিমা হাউমাউ করে বলছিলেন, ‘এমন দশা ক্যামনে হইছে রে। আমার রোহান যন্ত্রণায় কাতরাইতাছে রে।’
এ রকম বিভিন্ন আহাজারি শোনা গেল সেখানে পোড়া শরীর নিয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মা-বাবার মুখে। তাঁদের অবলম্বন ছিল এই আহাজারি। কেন পুড়ে গেল নিষ্পাপ সন্তানের শরীর—এমন প্রশ্ন চারদিককে বিদীর্ণ করছিল।
আহতদের উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল হাসপাতাল ও কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালেও নেওয়া হচ্ছিল। রক্তের জন্য আগ্রহীদের অ্যাম্বুল্যান্সে করে নেওয়া হচ্ছিল। উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আহত ও নিহতদের খুঁজতে জরুরি বিভাগের সামনে ভিড় করছিল স্বজনরা। মাইলস্টোন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী আফিয়ার খোঁজ করছিলেন তার মা। পরে তিনি অবশ্য জানতে পারেন, আফিয়াকে বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়েছে। আফিয়ার মা বলেন, ‘আমার মেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে, আমি আমার মেয়েকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। একটু বলেন, আমার মেয়ে কোথায় আছে?’
ফায়ার সার্ভিস জানায়, গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আহত ১১৬ জনকে।
উত্তরার হাসপাতালগুলোতে ছুটছিলেন অভিভাবকরা : অনাথ নাতনিকে খুঁজতে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটছিলেন ৬৫ বছর বয়সী দাদা হারুন। তাঁর নাতনি শারমিন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। শারমিনের মা-বাবা ছোটবেলায় মারা যান। তার পর থেকে নাতনিকে নিজের কাছে রেখে স্নেহ-মায়ায় বড় করছিলেন হারুন। কিন্তু হঠাত্ করে সেই মায়ায় যেন ছেদ পড়েছে। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বেলা ১টা ৬ মিনিটে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলের একটি ভবনে আছড়ে পড়ে এবং আগুন ধরে যায়। এতে স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী হতাহত হয়। তাদের অনেকেই ওই আগুনে পুড়ে যায়। আহতদের দ্রুত সময়ের মধ্যে উত্তরার বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। পরে আশঙ্কাজনক রোগীদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়।
সন্তানদের খোঁজে অভিভাবকরা উত্তরার বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটে যান। মোবাইলে ছবি নিয়ে সন্তানের খোঁজ করছিলেন তাঁরা। তাঁদেরই একজন গাজীপুরের বাসিন্দা হারুন। উত্তরার কয়েকটি হাসপাতালে নাতনিকে খুঁজে না পেয়ে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে এসে স্তব্ধ হয়ে যান। এক পর্যায়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কাঁদতে শুরু করেন। অস্পষ্ট সুরে বলতে থাকেন, ‘আমার নাতনিটা এতিম, তার কষ্টের শেষ নেই। তার সঙ্গেই কেন এ রকম হলো।’ নাতনিকে ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশায় তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নেন। পকেটে টাকা কম থাকায় সহায়তা চান আশপাশের লোকজনের কাছে। শুধু হারুন নন, উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে মাইলস্টোন স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ভাতিজা রিজভীকে খুঁজতে প্রতিটি তলায় দৌড়াচ্ছিলেন এক যুবক। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার ভাতিজা স্কুলে গিয়েছিল আজ। দুর্ঘটনার কথা শুনে আমরা সবাই স্কুলে গিয়ে দেখি, বাচ্চাদের সবাইকে নাকি হাসপাতালে নিয়ে গেছে। কিন্তু কোন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে সেটা কেউ নিশ্চিত বলতে পারছে না। আমরা দুপুর দেড়টা থেকে হাসপাতালগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমরা চাই অন্তত আমাদের রিজভী বেঁচে থাকুক।’ বোন সায়মাকে খুঁজতে হাসপাতালে এসেছিলেন আরো দুই বোন পারভীন ও মুক্তি। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী নিধিকে খুঁজতে এসে বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন বাবা মো. ফারুক।
এদিকে শিক্ষার্থী জাহেরাকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে নিখোঁজ হন মা লামিয়া আক্তার। সামান্য আহত অবস্থায় জাহেরাকে পাওয়া গেলেও মায়ের খোঁজে হাসপাতালগুলোতে যাচ্ছেন স্বজনরা। হাসপাতালের প্রত্যক্ষদর্শী স্টাফরা জানান, গুরুতর দগ্ধ হওয়া রোগীদের দৃশ্য দেখার মতো না। আহতদের সবাই আগুনে পোড়া। কোনো কোনো শিক্ষার্থী এতটাই গভীরভাবে পুড়েছে যে শরীরের মাংস খসে পড়ছিল। প্রাথমিক চিকিত্সা ও স্যালাইন দিয়ে তাদের প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়।
বিকেল ৪টার দিকে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক এস এম রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘দুপুরের পর থেকে এই হাসপাতালে ১৬০ জন চিকিত্সা নিয়েছে, যাদের মধ্যে ৪০ থেকে ৪৫ জনের অবস্থা ছিল গুরুতর। সবার শরীর ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদের বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে।
হাসপাতালগুলোতে রক্তদাতার ভিড় : উত্তরার বিভিন্ন হাসপাতালে আগত রোগীদের রক্ত দিতে ভিড় জমান কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ। তাঁরা নিজেদের রক্তের গ্রুপ ও ফোন নম্বর কাগজে লিখে হাত উঁচিয়ে রাখেন। আবার কোনো কোনো স্বেচ্ছাসেবক আগত ডোনারদের কাছ থেকে তাঁদের ফোন নম্বর ও রক্তের গ্রুপ লিখে তালিকা করে রাখছিলেন জরুরি প্রয়োজনের জন্য। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছার জন্য সড়কে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। তবে রক্তদাতার সংখ্যা বেশি হওয়ায় স্বেচ্ছাসেবকরা হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা করছিলেন, রক্ত দিতে আগ্রহীরা যেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যান।
উত্তরার আধুনিক হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি আহতদের নিয়ে আসা হয়েছিল।
Leave a Reply