ডিএস নিউজঃ
৫অগাস্ট বা ৩৬ জুলাই, তারিখটিকে যেভাবেই নাম দেয়া হোক, ঠিক এক বছর আগে এই দিনেই ইতিহাসের বাঁক ঘুরে যায় বাংলাদেশের। এমনকি শেখ হাসিনাও হয়তো ভাবেননি এই অগাস্টই তাকে জীবনের এক নির্মম বাস্তবতায় এনে ফেলবে। স্বজন হারানোর পাশাপাশি, চিরতরে ক্ষমতা হারা হয়েও তাকে পাশের দেশে আত্মগোপনে থাকতে হবে।
শেখ হাসিনার দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনে যবনিকা পড়ে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণের মাধ্যমে—যা ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ নামে। এই দিনে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলন ও আত্মদানের মধ্যে দিয়ে সূচিত হয়েছিল একটি নতুন যুগের, গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণের।
৫ আগস্ট বা ৩৬ জুলাইয়ের এই দিন আজ পালিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রার্থনার আয়োজন হয়েছে, শহীদদের স্মরণে চলছে নানা আয়োজন। জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দিনব্যাপী ৩৬ জুলাই উদযাপনের অংশ হিসেবে এ দিন বিকেল ৫টায় এই ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করা হবে।
কোন মন্তব্যে আসলে হাসিনার রাজত্বের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিল? তার কোন ভুলেই জন্ম হয়েছিল ৩৬ জুলাইয়ের নতুন বাংলাদেশের? ১৪ জুলাই কোটা আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে হঠাৎ নিজের অহংকার জাহির করে হাসিনা বলেছিলেন, কোটা মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা পাবেনা নাতো কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে। আর এই মন্তব্যেই মূলত ধসে পড়ে তার ১৬ বছরের স্বৈরাচারি সাম্রাজ্য।
এ বক্তব্য আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। “আমি রাজাকার” ব্যানারে শুরু হয় প্রতিরোধের এক নতুন অধ্যায়। ১৮ জুলাই সেসময়কার আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের হাত ধরে ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউটে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ছাত্র-জনতার মাঝে। আর আশংকা করা হয় গুম-খুনের। এরপর সেই ছাত্র আন্দোলন রূপ নেয় গণ আন্দোলনে।
একে একে শিক্ষক, অভিভাবক, সুশীল সমাজ, পেশাজীবী সংগঠন, এমনকি সরকারি চাকরিজীবীরাও যোগ দেন এই যাত্রায়। ‘দ্রোহযাত্রা’, ফেসবুকে প্রোফাইল ছবি লাল করা , ‘জাস্টিস ফর মার্চ’—সবই একে একে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে রাজনীতির অঙ্গনে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হয়েছিল যে আন্দোলন, তা বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রূপ নেয় একপ্রকার গণঅভ্যুত্থানে। হাইকোর্টের রায়ে কোটা বহালের পর শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ বিস্ফোরণ ঘটে। ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলন’ ব্যানারে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রতিটি ক্যাম্পাসে।
কিন্তু আন্দোলন দমনে সরকারের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, পুলিশি গুলি, ছাত্রলীগের হামলা, এবং কথিত ‘হেলমেট বাহিনীর’ সহিংসতা আগুনে ঘি ঢালে। বিশেষ করে ১৬ জুলাই পুলিশের সামনে বুক চিতিয়ে দাড়ানো বেরোবির ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যুর মুহূর্তটি গোটা জাতিকে কাঁপিয়ে দেয়। রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ, গর্জে ওঠে পুরো দেশ।
১৯ জুলাই থেকে কারফিউ ঘোষণা করলেও যেদিন ছিল ‘মার্চ টু ঢাকা’, অর্থাৎসেই ৫ আগস্ট, অবশেষে কারফিউ উপেক্ষা করে লাখো মানুষ ঢাকায় জমায়েত হয়। বিক্ষোভের চাপে, অভ্যন্তরীণ চাপ ও আন্তর্জাতিক মহলের অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে দিনে দুপুরে সামরিক বিমানে পালিয়ে দেশত্যাগ করেন তিনি। ইতিহাসে সূচনা হয় এক নতুন অধ্যায়ের ।
আজকের ‘৩৬ জুলাই’তাই শুধুমাত্র শেখ হাসিনার পতনের দিন নয়, এটি একটি দেশের নতুনভাবে জন্ম নেওয়ার দিন। এটি গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি রক্ষার দিন। দিনটি বুক চিতিয়ে দাড়ানো শহীদ আবু সাঈদের বুকের রক্তে লেখা এমন এক কবিতা, যে কবিতায় দেশ আজ ৩৬ জুলাই হয়ে জন্ম নিয়েছে নতুনভাবে।
Leave a Reply